Wednesday, May 21, 2025

শিশুদের হাতে হাতে নিম্নমানের বই

বিবাংলা ডেস্ক
০ মন্তব্য ৩৬ views

চলতি শিক্ষাবর্ষে ৪০ কোটির বেশি বিনামূল্যের বই ছাপিয়ে স্কুলে স্কুলে পাঠানো হয়েছে; কিন্তু দরপত্রের স্পেসিফিকেশন (নির্ধারিত মান) অনুযায়ী ছাপানো হয়নি এমন অভিযোগে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে সরকার। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নেতৃত্বে দুটি পরিদর্শন সংস্থা ও দুটি গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত ৩২টি দল ৬৪ জেলায় অভিযান চালায়। এতে ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে প্রায় ৮ কোটিই নিম্নমানের গেছে এমন তথ্য মিলেছে। যেসব প্রিন্টার্সের (মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান) বই নিম্নমানের, তাদের বিল আটকে দেওয়াসহ কালো তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

এনসিটিবির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, কঠোর মনিটরিংয়ের পরও নিম্নমানের বই গেছে-এমন তথ্য পাওয়ার পর শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার এনসিটিবিকে এসব তথ্য যাচাই করতে টিম গঠনের নির্দেশ দেন। এরপর গত এপ্রিল থেকে এ অভিযান শুরু হয়। এনসিটিবি বিভিন্ন পর্যায়ের দুজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে ৩২টি টিম করে মাঠপর্যায়ে পাঠানো হয়। টিমগুলো সদর জেলা ও উপজেলা শহর ব্যতীত মফস্বল এলাকা থেকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে বই সংগ্রহ করেছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে টিমগুলো সারা দেশ থেকে নিম্নমানের বই শনাক্ত করার কাজ শেষ করে এখন প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছে। তার আগে মাঠপর্যায় থেকে আনা বইগুলো বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), বুয়েট বা বিএসটিআই ল্যাবে পরীক্ষা করিয়েছে। অন্যদিকে, বইয়ের মান যাচাই করতে হাইটেক সার্ভে বিডি নামে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে বই ছাপার পরের মান যাচাইয়ের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই প্রতিষ্ঠানটিও মাঠপর্যায় থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করাচ্ছে। একই পদ্ধতিতে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় মাঠপর্যায় থেকে বই সংগ্রহ করে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা।

জানা গেছে, এসব টিম দরপত্রের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী বইয়ের ছাপার মান ও কভার কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে কি না, কাগজের জিএসএম ও ব্রাইটনেস এবং আর্ট কার্ড ঠিকমতো দেওয়া হয়েছে কি না, তা যাচাই করে। এ ছাড়া বইয়ের মুদ্রণ, ছবি ও বাঁধাই সঠিকভাবে হয়েছে কি না, তাও যাচাই করে। একাধিক টিমের সদস্য ও হাইটেক সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, সংগৃহীত বইয়ের মধ্যে ২০ শতাংশ নিম্নমানের পাওয়া গেছে। সেই হিসাবে ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে ৮ কোটি বই নিম্নমানের।

এনসিটিবির একজন সদস্য খুলনা অঞ্চলে যান। তিনি জানান, দুটি জেলা থেকে ২৫০টির বেশি বই সংগ্রহ করেন, যার ৫৩টি বই নিম্নমানের।

হাইটেক সার্ভের প্রজেক্ট ম্যানেজার শাহ জামান কালবেলাকে বলেন, এনসিটিবির নির্দেশনা অনুযায়ী সদর উপজেলা ব্যতীত প্রতিটি উপজেলা থেকে বই সংগ্রহ করা হয়েছে এবং সেগুলো ল্যাবে পরীক্ষা হয়েছে। তাদের একটি বড় দল সারা দেশে ঘুরে বইগুলো সংগ্রহ করেছে। বই সংগ্রহের ক্ষেত্রে তারা বইয়ের মান, উপজেলার জন্য বরাদ্দকৃত সব বই পাওয়া গেছে কি না, ছাপার মান দরপত্র অনুযায়ী হয়েছে কি না এবং বইয়ের ছাপায় ভুল গেছে কি না, এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাদের প্রতিবেদনে মাঠপর্যায়ের সার্বিক চিত্র এনসিটিবি জানতে পারবে। এ কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ আসছিল, তবে সেগুলো উপেক্ষা করে নিরপেক্ষ প্রতিবেদন দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি।

এনসিটিবি সূত্র বলছে, দেশব্যাপী এ অভিযান ঠেকাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং এনসিটিবির প্রাক্তন চেয়ারম্যান তৎপরতা শুরু করেন। শিক্ষা উপদেষ্টার নির্দেশে ১৭ এপ্রিল দুপুরে টিম গঠন করে চিঠি তৈরি হয় এবং সন্ধ্যায় সেই চিঠি বাতিল করে এনসিটিবি। মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার নির্দেশে সেই চিঠি বাতিল করা হয় বলে সূত্রের দাবি। যদিও উপদেষ্টার হস্তক্ষেপে ২৩ এপ্রিল আবার টিম গঠন করা হয়।

এনসিটিবির নথিপত্র বলছে, চলতি বছর বইয়ের মান ঠিক রাখতে দুটি পরিদর্শন এজেন্সি ছাড়াও এনসিটিবির কর্মকর্তারা মাঠে ছিলেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক টিম ছাড়াও প্রথমবারের মতো দুটি গোয়েন্দা সংস্থা ও শিক্ষা ক্যাডারের ১৫০ জন কর্মকর্তাকে এ কাজে যুক্ত করা হয়। তারা প্রেসে প্রেসে আকস্মিক ভিজিট করেন। এত তদারকির পরও নিম্নমানের বই গেছে স্কুলে স্কুলে। এর কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায়, বই ছাপার আগে ও পরে মান তদারকির জন্য এনসিটিবি প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) ও পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন (পিএলআই) এজেন্ট নিয়োগ করে। চলতি বছর এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা করে প্রিন্টার্সরা নিম্নমানের বই দিয়েছে। বই ছাপার আগে তিন স্তরে তদারকির কথা পরিদর্শন এজেন্সির। প্রথমে প্রেসে কাগজের মান (স্থায়িত্ব ও জিএসএম) ঠিক আছে কি না, তা দেখে ছাড়পত্র দেবে, ছাপা ও ডেলিভারির আগে বইয়ের মান দেখে ছাড়পত্র দেবে। এই স্তরকে পিডিআই বলে। এজন্য গভীর রাতে নিম্নমানের বই ছাপানো হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য প্রেসে প্রেসে ২৪ ঘণ্টার তদারকি কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার কথা; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। প্রাথমিক স্তরের পরিদর্শন এজেন্সির জনবল থাকলেও মাধ্যমিক স্তরের কাজ পাওয়া ‘ব্লু বাইন্ডার্স’ এজেন্সির সেই জনবল ছিল না। শুধু তাই নয়, কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর মেশিন, স্টিফনেস মেশিন ও গ্লস মেশিন ছিল না। এর আগে দায়িত্বে অবহেলা ও অনৈতিক কাজের জন্য কালো তালিকাভুক্ত ছিল। দরপত্রে ছয় নম্বর দরদাতা হয়েও তৎকালীন চেয়ারম্যানের পছন্দে কাজ পায় প্রতিষ্ঠানটি। তাদের কারণে চলতি বছর মাধ্যমিকে নিম্নমানের বই ছাপানো ঠেকানো যায়নি এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

এ ব্যাপারে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, দরপত্রে উল্লেখ আছে এনসিটিবি চাইলে পরিদর্শন সংস্থা ছাড়াও নিজস্ব কৌশলে মাঠপর্যায়ে বইয়ের তথ্য যাচাই করতে পারবে। এতদিন সেই ক্ষমতা ব্যবহার করা হয়নি। এবার তা করা হচ্ছে। ফলে মাঠ থেকে বইয়ের সঠিক মান জানা যাবে। এনসিটিবির সচিব অধ্যাপক মাহতাব উদ্দিন কালবেলাকে মাঠের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, তিনি কক্সবাজার সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের একটি মফস্বল স্কুল থেকে বই সংগ্রহ করেছেন। তার মতে, প্রিন্টার্সরা সাধারণত সদর জেলা ও উপজেলায় ভালো মানের বই দেওয়ার চেষ্টা করে। এ কারণে প্রকৃত তথ্য জানতে মফস্বল থেকে বই আনা হয়েছে।

এনসিটিবির নথি অনুযায়ী, ৫ আগস্টের পর আগের দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র আহ্বান করায় প্রিন্টার্সরা সমঝোতার মাধ্যমে গড়ে ২০ শতাংশের বেশি দামে কাজ নেয়। এতে সরকারের প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হয়। হাতে সময় না থাকায় সরকার দরপত্র বাতিল করে পুনঃদরপত্র দিতে পারেনি। তবে বইয়ের মান ঠিক রাখতে কাগজের বাস্টিক ফ্যাক্টর ১৫ থেকে ১৬ নির্ধারণ করে, যাতে নিম্নমানের বই ঠেকানো যায়। প্রথমদিকে তদারকি টিম তৎপর থাকায় প্রাথমিকের বইয়ের মান নিয়ে তেমন প্রশ্ন না উঠলেও দ্বিতীয় ও শেষ ধাপে ছাপা হওয়া মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, পিডিআইর দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা, জনবল সংকট এবং প্রেস মালিকদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে নিম্নমানের বইয়ের ছাড়পত্র দিয়েছে।

এ ব্যাপারে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান কালবেলাকে বলেন, সরকারের এত সংস্থা ও এজেন্সির তদারকির পরও নিম্নমানের বই সরবরাহ হওয়া মানে বুঝতে হবে সর্ষের মধ্যে ভূত আছে। শেষের দিকে তৎকালীন চেয়ারম্যানের নির্দেশে পরিদর্শন এজেন্সি বইয়ের মান ভালোভাবে না দেখেই ছাড়পত্র দিয়েছে। এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তার সদিচ্ছার অভাবে এবারও নিম্নমানের বই ঠেকানো যায়নি।

এনসিটিবি সূত্র জানায়, নিম্নমানের বই ছাপানো ও সরবরাহ ঠেকাতে না পেরে পাঁচটি বড় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বিল আটক এবং চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নোট অব ডিসেন্ট (দ্বিমত পোষণ) দেন একজন সদস্য। পরবর্তী সময়ে ওই সদস্যকে এনসিটিবি থেকে বদলি করা হয়। এ ঘটনার পর সবার মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হয় এবং চেয়ারম্যান যা বলতেন, কর্মকর্তা ও এজেন্সিগুলো তাই পালন করত।

আরো পড়ুন

একটি মন্তব্য লিখুন

আমাদের সম্পর্কে

বাঙালীর সংবাদ বাংলা ভাষায়, সবার আগে সেরা সংবাদ পেতে বি-বাংলা ভিজিট করুন।

আজকের সর্বাধিক পঠিত

নিউজলেটার