ইউনুস সরকারের চার মাসের হিসাব নিকাশ
সৈয়দ ইফতেখার হোসেন
৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অসাংবিধানিক ইউনুস সরকার চার মাস পার করল। জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য এবং সামগ্রিক নৈরাজ্যের পাশাপাশি দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা ইউনুসের দোসরদের ধর্মীয় উন্মদনা সৃষ্টি করে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক সমস্যার তৈরি, যার প্রধান শিকার সংখ্যালঘু সনাতন ধর্মের মানুষ। তাদের দুর্দশার প্রতি ইউনিসের সরকারের উদাসীনতা বাংলাদেশের ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে মিলে যায়। প্রধান উপদেষ্টা ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন, নির্যাতনের তেমন প্রমাণ তাঁর কাছে নেই।
বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হচ্ছে। আইনের শাসন গত চার মাসে তলানিতে ঠেকেছে। আটক রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী, এমনকী সাংবাদিকরা। বিএনপি-জামায়াত আইনজীবীদের হাতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় তারা আদালতে জামিনের আর্জি জানাতে যেতে পারছেন না। রায় পছন্দ না হলে বিচারপতিকে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়া হচ্ছে। ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণের জন্য কোনও আইনজীবী মামলা লড়তে ভয় পাচ্ছেন।
বিগত চার মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছে, বিশেষ করে সনাতন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের কারণে। বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়াতে ভারত কড়াকড়ি বহাল রেখেছে। কলকাতার কোনও কোনও হাসপাতালে এরই মধ্যেই বাংলাদেশিদের চিকিত্সা দিতে অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশও ভারতীয়দের জন্য ভিসা প্রদান সীমিত করেছে। ভারতের কোনও কোনও জেলায় হোটেলগুলোতে বাংলাদেশিদের থাকার জায়গা হচ্ছে না।
অন্য দিকে যে দেশটি মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা আর তিন লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহানী করেছে সেই পাকিস্তানকে ইউনুস বুকে টেনে নিয়েছেন। পাকিস্তানিদের জন্য ভিসা প্রাপ্তি সহজ করেছে। এরফলে বাংলাদেশে পাকিস্তান, তাদের পাশের প্রতিবেশী তালেবানি রাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে জঙ্গি আমদানি সহজ হল।
বিগত চারমাসে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, ইউনুসের একমাত্র যোগ্যতা তিনি মনেপ্রাণে আওয়ামী লিগ ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী। এমন সব অদূরদর্শী ব্যবস্থার কারণে ইউনুস এবং তার উপদেষ্টারা বাংলাদেশকে ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে, এই অসাংবিধানিক সরকারের মেয়াদ কতদিন? জামায়াতে ইসলামি চায় ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার নির্বাচিত সরকারের বাকি মেয়াদ শেষ করুক। তারা নিঃশব্দে তাদের অনুগামীদের সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছে। দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি তাদের দখলে। আমলাতন্ত্র তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। চারদিকে চলমান নৈরাজ্যের সুযোগ নিয়ে জামায়াত ক্রমশ তাদের অবস্থান সুসংহত করছে। দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছু থেকে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মকে বিচ্ছিন্ন করার একটি জোরালো কর্মসূচি বাস্তবায়নে তারা ব্যস্ত। এই ব্যাপারে তাদের সার্বিক সহায়তা করছে ইউনুস সরকার।
দেশের অন্যতম বিরোধী দল বিএনপি, যারা আওয়ামী লিগ বিহীন একটি ভোট হলে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে তারা দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের একটি রোড ম্যাপ চায়। তারা ২০০৬ সাল থেকে ক্ষমতার বাইরে। বাম দলগুলি এ ব্যাপারে তেমন একটা সরব নয় কারণ তারা কখনও এই দেশে কোনও নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা দেখে না। জামায়াত যেমন ইউনুস বা বিএনপির কাঁধে চড়ে ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে
বিগত চার মাসে ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসকে মুছে ফেলার অভিপ্রায় বাস্তবায়নে খুবই সচেষ্ট। সরকারের পৃষ্ঠপোষকরা সংবিধান থেকে জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ মুছে ফেলতে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। সরকারের এক উপদেষ্টা যাঁকে ইউনুস গণ অভ্যুত্থানের মাস্টার মাইন্ড বলেছেন, সেই মাহফুজ আলমের কথায় বঙ্গ ভবন থেকে শেখ মুজিবুরের ছবি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোভিডের সময় বাদে দেশে এই প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালিত হচ্ছে না। সামরিক কুচকাওয়াজ বাতিল করা হয়েছে। কোন আলোচনা অনুষ্ঠান হবে না।
দেশজুড়ে লাগামহীন মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দূর্বিষহ করে তুলেছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশে উপনিত হয়েছে এই চার মাসে। পথে ঘাটে মানুষ বলছে ‘আগেই ভাল ছিলাম’। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে চার মাসে কয়েক লাখ মানুষ বেকার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। নতুন বিনিয়োগ নেই। দেশ ছাড়ছে বহু বিদেশি বিনিয়োগকারী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশৃংখলা চলমান। শিক্ষকেরা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষকরে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। চার মাসে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই সাতটি কলেজ বন্ধ হয়েছে। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরা পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছে না।
দেশের মিডিয়া পোষ্যের মতো আচরণ করছে। ‘মব জাস্টিস’-এর আতঙ্ক থেকে মুক্ত নয় মিডিয়াও। দেশের প্রথমসারির দৈনিক ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলো’কে আওয়ামী লিগপন্থী এবং ভারতপন্থী বলে অভিযুক্ত করে উন্মত্ত জনতা আক্রমণ করেছে একাধিকবার। অথচ এই দুটি পত্রিকা সব সময় শেখ হাসিনা সরকারের বড় সমালোচক ছিল। কয়েক ডজন সাংবাদিক হয় কারাগারে বা হত্যা মামলার আসামি হয়ে পলাতক। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মিডিয়া বিশ্বের সবচেয়ে আতঙ্কগ্রস্থ সংবাদমাধ্যম। সম্পাদকরা ভয়ে কুঁকড়ে থাকেন।
রাজনীতি ও ইতিহাসের বিচারে বাংলাদেশ ৫ আগস্ট থেকে অন্ধকারে নিমজ্জিত। মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক কাঠামোগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের কেউ কখনও এ ধরনের নাশকতার নিন্দা পর্যন্ত করেনি। পরিবর্তে, ইউনুস সরকারের ইতিহাস-বিরোধী পদক্ষেপ অকল্পনীয়।
গত চার মাসে ইউনুসের অন্যতম কীর্তি হল নিজের বিরুদ্ধে থাকা করফাঁকির মামলা এবং ৬৬৬ কোটি টাকা পরিশোধের হকুম থেকে অব্যাহতি পাওয়া, ২০২৯ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংককে করমুক্ত ঘোষণা করা। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি ট্রাস্টের উপর কর ধার্য করেছেন। এটি তার প্রতিহিংসার এক ন্যক্কারজনক নজির হয়ে থাকবে। ১৮ জুলাই থেকে ৮ আগষ্ট দেশে সব ধরনের হত্যাকা্লের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের দায় মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কারণ যারা এই সব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরাই তাঁকে ক্ষমতায় বসিয়েছে।
বাংলাদেশের সার্বিক সংকট বর্তমানে দেশটিকে এক ভয়াবহ বির্পযয়ের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি চলমান থাকলে ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশ অচিরেই হয়ে যেতে পারে সিরিয়া, সোমালিয়া অথবা আফগানিস্তান। এরই মধ্যে দেশে হিযবুত তাহরির, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম, হুজি, আইসিসের মতো সংগঠন সরকারি পৃষ্টপোষকতায় তাদের ভীত পাকাপোক্ত করেছে।
ইউনুসের অসাংবিধানিক সরকারের চার মাস পরেও আরেকটি বাস্তবতা আছে যা উপেক্ষা করা যায় না। সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনা এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ৫ অগাস্ট দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে সেনাবাহিনী তাঁকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ দেয়নি। এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের চেষ্টা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি নিজ পদে ইস্তফা দিলে সাংবিধানিকভাবে সংসদের স্পিকার পরবর্তী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী আগেই ইস্তফা দিয়েছেন। ডেপুটি স্পিকার কারাগারে। পরিস্থিতি বেশ জটিল।
এরই মধ্যে ইউনুস ও তাঁর পারিষদদের বিরুদ্ধে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে জোরপূর্বক অসংবিধানিকভাবে একটি দেশের নির্বাচিত সরকারকে হঠিয়ে ক্ষমতা দখলের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এই অভিযোগের নিষ্পত্তি হলে ড. ইউনুসের জীবনের আর একটি ধূসর অধ্যায়ের যাত্রা শুরু হতে পারে। বিপদে পড়তে পারেন তাঁর দোসররা। ইউনুসের শাসনের চার মাসের মাথায় দেশের মানুষের শান্তির আকুতি অতীতের তুলনায় অনেক জোরালো।
লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মতামত ব্যক্তিগত।